রক্তক্ষয়ী নির্বাচন : দ্য ডিপ্লোম্যাট

এই বছরজুড়ে এশিয়ায় কিছু অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফল দেখা গেছে। মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের পতনের মাধ্যমে দেশটির গণতান্ত্রিক অবনমন থেমেছে। মালয়েশিয়ায় ইউনাইটেড মালয়িজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের ৬১ বছরের দীর্ঘ কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসান ঘটেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে শান্তিপূর্ণ উত্তরণে মালয়েশিয়ার দেখাদেখি এখন আরেকটি মধ্যপন্থী গণতন্ত্র অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিবিধির ওপর সবার চোখ।

৩০ ডিসেম্বর প্রায় ১০ কোটি ভোটার দেশের ৩০০টি আসনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এশিয়ার এই দেশটির বিরুদ্ধেও গত এক দশকে গণতন্ত্র থেকে পশ্চাৎপদের অভিযোগ রয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতি হয়েছে ধারাবাহিক।

বেশ কয়েকটি কারণেই এই বছরের নির্বাচন ঐতিহাসিক। প্রথমত, এবারের নির্বাচন হবে ৩০ ডিসেম্বর, যে মাসে দেশের ৪৮তম বিজয় দিবস উদযাপন করেছে লাখো মানুষ। পূর্ববর্তী জাতীয় নির্বাচন দেশের প্রধান বিরোধী দল বর্জন করেছিল।

ওই নির্বাচন শেষ হয় ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে। এ বছর অবশ্য বিরোধী দল যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকতে চায়।

মাহাথির বিন মোহাম্মদের মতো, বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জারও বর্তমান শাসক দলের সদস্য ছিলেন এ কসময়। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধানরচয়িতা ড. কামাল হোসেন আবার দেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটাতে জোট তৈরি করেছেন।

এ কারণে শাসক দলের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে না পারলে আইনের শাসন খর্ব হবে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাবে ও দেশের উন্নয়নের অগ্রগতি হুমকিতে পড়বে। অপর দিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে হয়তো কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসান ঘটে যেতে পারে। তবে যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ হয়তো প্রথম পথেই এগোচ্ছে।

নির্বাচনের আগে ঢাকার অবস্থা বেশ উত্তাল। নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগের মতো গুরুত্বপর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। তাহলে ৮১ বছর বয়সী প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন কি সব প্রতিকূলতা উতরিয়ে ৯৩ বছর বয়সী মাহাথিরের মতো পাশার দান উলটে দিতে পারবেন?

নির্বাচনী প্রচারণা ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের বিরোধী নেতারা প্রায় দিনই হামলার শিকার হয়েছেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী প্রকাশ্যে শাসক দলের ক্যাডারদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন অনেককে মিথ্যা অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার পর থেকে প্রায় ২১ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।

শাসক দলের ক্যাডাররা বিরোধী দলের নির্বাচনী অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। নারী প্রার্থীর ওপরও হামলা করেছে। এমনকি ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলা করেছে। ব্যাপকভাবে নির্বাচনী নিয়মনীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।

স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিতের বদলে নির্বাচন কমিশন বরং উল্টোটা করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ সৃষ্টি করেছে। যেমন, ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার ও ফোনে ভিডিও ধারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমালোচকেরা বলছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যে পরিবেশ প্রয়োজন তা দুর্বল করতে শাসক দলের সমন্বিত কৌশলের অংশ এসব।

বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনী সহিংসতা নতুন কিছু নয়। দশম সংসদ নির্বাচনের পরও রাজপথে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছিল। এতে অনেকের প্রাণহানি ও সরকারি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। নির্বাচন-পরবর্তী যে ভয়াবহতা দেখা গেছে সে জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে শাসক দল। এ কারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবাদ-রাজনীতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বেশ কৌতূহল উদ্দীপক।

নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার পেছনে যুক্তি

নির্বাচনের আগে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টির যে কৌশল নিয়েছে শাসক দল তা থেকে দলটি অন্যায়ভাবে লাভবান হবে। বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করাটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করবে। এ ছাড়া প্রাথমিক লক্ষ্য, অর্থাৎ ভোটারদের উপস্থিতিকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সহিংসতার কারণে রাজধানী ঢাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। শ’ শ’ ভোটকেন্দ্র আগে আগেই বন্ধ হয়ে যায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রই ছিল দুই পক্ষের বিবাদে ভুক্তভোগী।

শাসক দলের রাজনীতিকদের কিংবা তাদের ক্যাডারদের ত্রাস কি ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে? স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা বিরল কিছু নয়। কঙ্গো ও বুরুন্ডির মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে নির্বাচনী সহিংসতার ইতিহাস অবশ্য বলে এ থেকে বরং উল্টোটা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার ভোটারদের মধ্যে ক্ষমতাসীন-বিরোধিতা প্রবল। প্রকাশ্যে হামলা ও ভিন্নমতকে দমাতে নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ হয়তো এই ধরনের ক্ষমতাসীন-বিরোধী অনুভূতিকেই শক্তিশালী করবে। আওয়ামী লীগের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করবে।

(নিয়াজ আবদুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব মালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক। অ্যান্তোনিও স্যাভোয়া ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। তাদের এই যৌথ সংক্ষেপিত নিবন্ধ ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন থেকে নেয়া হয়েছে।)

সূত্রঃ নয়াদিগন্ত